শিশুর বিকাশ: কি কেন কিভাবে

নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জন্ম নেয় মানব শিশু। এরপর শিশুর মা-বাবা পরিবারের প্রধাণ চিন্তা শিশুর যত্ন ও পরিপূর্ণ বিকাশ। আমরা অনেকেই ভাবি, শিশু আকারে বড় হওয়া, ওজন বাড়া দেখতে নাদুসনুদুস হওয়াই শিশুর বিকাশ । শিশুর বৃদ্ধি একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শিশুর বিকাশ বলতে বোঝায় তার বুদ্ধিবৃত্তিক , মানসিক এবং সামাজিক দিক থেকে যে কাজ সেই কাজ সে ঠিকঠাক করছে কিনা এবং দক্ষতার বিকাশ হচ্ছে কিনা। এটি মূলত শিশুর পূর্ণাঙ্গভাবে বড় হওয়াকে নির্দেশ করে । কেবল গায়ে গতরে বড় হওয়াই শেষ কথা নয়। বরং বয়সের সাথে সাথে তার ইতিবাচক আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে কিনা তা যাচাই করা উচিৎ।

 

শিশুর বিকাশের কতটা হচ্ছে এর বেলায় বাবা-মায়েরা সাধারণত বেশি নজর দেন শিশু কোন বয়সে হামাগুড়ি দিতে পারল, কখন হাটতে পারল, কখন কথা বলা শিখতে পারল—এসবের ওপর। এগুলো শিশুর শারীরিক বিকাশ। কিন্তু শিশুর বিকাশের আরও কিছু ধারা রয়েছে। মায়ের গর্ভে থাকার সময় থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর যে বিকাশ ঘটে, তা হচ্ছে প্রারম্ভিক বিকাশ। শৈশব থেকে কৈশোর, বয়ঃসন্ধিকাল পার করে সে হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ মানুষ। প্রতিটি পর্যায়ে শরীরের পাশাপাশি তার মনেরও পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার ও ভাষা, চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি, জ্ঞান, বুদ্ধি, আবেগ, নৈতিকতা ও ভাবের আদান–প্রদানের ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে দক্ষ হয়ে ওঠাই শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ। সুতরাং শিশুটির বৃদ্ধির ধরনে লক্ষ রাখা যতটা গুরুত্বপূর্ণ তেমনই তার বিকাশের দিকেও নজর রাখা ততটাই জরুরি।

 

একটি শিশুর বিকাশ শুরু হয়ে যায় মায়ের গর্ভ থেকেই । যা একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিকাশের স্তর অনুযায়ী এক এক বয়সে শিশু এক একটি কাজ করবে। প্রায় সব বাবা মা-ই সাধারণত বেশি নজর দেন শিশু কবে হামাগুড়ি দিলো, কখন হাঁটতে শিখলো, কখন কথা বলতে বা ডাকতে শিখলো এসব দিকে। এগুলো শিশুর শারীরিক বিকাশের অংশ। এর পাশাপাশি তার মানসিক বিকাশের দিকেও নজর দেয়া উচিত।বয়স অনুযায়ী শিশু কাজকর্ম করছে কি না সেদিকে নিয়মিত নজর রাখা উচিত প্রত্যেক মা-বাবার।  মাথায় রাখতে হবে দুটি বাচ্চার বিকাশ সমগতিতে হয় না।কখনো কখনো তার বিকাশ কোনো কোনো বিষয়ে সমবয়সের অন্য বাচ্চাদের তুলনায় ধীরে হতে পারে। কিন্তু অন্য বিষয়ে হয়তো অন্যদের থেকে অনেক আগে হতে পারে। শিশু নিজে প্রস্তুত না হলে তাকে হাঁটতে শেখার জন্য জোর করলে কোনো উপকার হয় না। তাই প্রত্যেক অভিভাবককে এ বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত।

 

শিশুর বিকাশের পাঁচটি ধাপ

 

সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর বিকাশ 

 

১। শিশুর জন্মের প্রথম দুই মাসে শিশু সাধারণত কেউ ডাকলে, বা কারোর আচরণে প্রতিক্রিয়া জানায় অর্থাৎ সাড়া দেয়। 

২। শিশু ধীরে ধীরে তার হাত পা নিজের মত করে নাড়াতে শেখে 

৩। কাছের জিনিস দেখতে পায় তারা। কোনো শব্দ শুনলে চমকে যাওয়া বা সাড়া দেয়া এ সময় স্বাভাবিক বৃদ্ধির লক্ষণ। 

৪। এ সময়গুলোতে শিশুর কান্না একটি অতি স্বাভাবিক বিষয়। 

৫। তৃতীয় মাসের শুরুতে শিশু তার অতি পরিচিতদের দেখে হাসতে শেখে। 

 

ইনফ্যান্ট শিশু

 

১। শিশুর এক বছর বয়স হতে না হতেই শিশু অনেক নতুন জিনিস শিখে ফেলে । তিন থেকে ছয় মাস বয়সে শিশু অতি পরিচিত চেহারা চিনতে শিখে ফেলে । বিশেষ করে মা বাবাকে আলাদা করে চিনতে পারে এবং মা বাবা ডাকলে আওয়াজে সাড়া দেয়।

২। শিশুর ঘাড় শক্ত হয় এবং মাথা স্থির করতে শিখে। দুই হাত এক করতে পারে।

৩। কান্নার আওয়াজ ছাড়াও শিশু নানা রকম শব্দ করতে পারে। প্রায়শ সেই শব্দ করে । এগুলো কথা বলতে চাওয়ার লক্ষণ 

৪। ছয় থেকে নয় মাস বয়সে শিশু কোনো সাপোর্ট ছাড়াই বসতে শেখে। ধরে দাঁড়া করালে বাউন্স করে বা হালকা লাফালাফি করে।

৫। কেউ নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয়। এই বয়সেই শিশুর যোগাযোগ করা শিখতে শুরু করে ।

৬। নয় থেকে বারো মাস বয়সে শিশু আঙ্গুল তুলে কোনো কিছু নির্দেশ করতে শেখে। কোনো জিনিস হাত দিয়ে তুলে মুখে দেয় এবং হামাগুড়ির চেষ্টা করে। কখনো কখনো ধরে ধরে দাঁড়াতেও শেখে।

 

টডলার বা হামাগুড়ি দেয়ার বয়স

 

শিশুর এক থেকে তিন বছর বয়স পর্যন্ত সময়টাকে বলা হয় টডলার স্টেজ। এই বয়সে শিশু একা একা দাঁড়াতে বা হামাগুড়ি দিতে পারে। কারো সাহায্য ছাড়াই হাঁটতে শেখে। এই বয়স থেকেই বোঝা যায় শিশুর ব্যক্তিত্ব কেমন হবে অর্থাৎ শিশু চঞ্চল বা সবার সাথে কতটা মিশতে পারে, চুপচাপ বা কথা একদম কম বলে কিনা এগুলো বিষয় প্রকাশ পেতে থাকে টডলার স্টেজ থেকেই। সারা ঘরময় ছোট ছোট কদমে দৌড়ানো, হাত নেড়ে যোগাযোগ করা, পরিচিত ছবি বা কিছু দেখে চিনতে পারা, রঙ পেন্সিল বা অন্যকিছু দিয়ে আঁকাআঁকির চেষ্টা করা, আধো বুলি থেকে শুরু করে ছোট ছোট বাক্য বলতে শেখা, এমনকি কিছু করার জন্য বলা হলে তা ঠিকঠাক পালন করতেও শিখে যায় এ বয়সেই।

 

প্রি স্কুল পর্যায়

 

১। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর প্রি-স্কুল পর্যায়। এই বয়সে শিশুর আগ্রহ সক্রিয়তা এসব বোঝা যায়। 

২। এই বয়সে শিশু নিজে নিজে কাজ করতে শেখে যেমন নিজে নিজে জামা প্যান্ট পরা, জুতা পরা, জামার বোতাম লাগানো এবং সাইকেল চালাতে পারে।

৩।একটি পুরো অর্থবহ বাক্য বলে সম্পূর্ণভাবে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। স্বাভাবিক প্রশ্নের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরও দিয়েও এই বয়েসী শিশুরা চমকে দিতে পারে।

৫। চার থেকে পাঁচ বছর বয়সেই শিশুরা সাধারণত টয়লেট ব্যবহার করা শিখে যায় এবং নিজেই পুরো কাজটি করতে শিখে ফেলে ।

 

স্কুলের বয়স বয়ঃসন্ধি ও কৈশোর 

 

১। পাঁচ থেকে সতেরো বছর বয়স হলো স্কুলে যাওয়ার বয়স। এই বয়সে শিশু আত্মনির্ভরশীল হতে শেখে । এ বয়েসেই তারা নিজের সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারে। 

২। ব্যক্তিত্ব কেমন হবে বোঝা যায় এই বয়েসেই। শিশুর চালচলন, কার্যকলাপ থেকে তার ব্যক্তিত্বের ব্যাপারটি পরিপূর্ণভাবে ফুটে ওঠে । তারা একজন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন মানুষ হিসেবে জীবনের এই পর্যায়ে আত্মপ্রকাশ করে।

৩। শিশু বিভিন্ন রকম কাজে বা প্রক্রিয়ায় তার আবেগ অর্থাৎ রাগ, দুঃখ, হতাশা, হিংসা, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বিভিন্ন রকম আচার আচরণের মাধ্যমে শিশু তার মনের ভাব প্রকাশ করে।

৪। বয়ঃসন্ধিকাল হলো শিশুর বিকাশ হওয়ার সম্পূর্ণ নতুন এক পর্যায়। শিশু বিভিন্ন রকম শারীরিক  ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় এই সময়টাতেই । বয়সের সাথে সাথে ছেলেমেয়েরা যেমন দ্রুত বড় হতে থাকে তেমনি তাদের চিন্তা চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায় ।

৫। বয়ঃসন্ধির এ সময়ে ছেলেমেয়ে উভয়ের প্রজনন ক্ষমতা ধীরে ধীরে বিকাশ হতে থাকে বলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ হয়। 

৬। এ বয়সের প্রাণচাঞ্চল্য ভেতরের সৃজনশীলতার বিকাশে অনেক বড় ভূমিকা রাখে।

ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার এই যাত্রায় বড় ধরনের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় প্রতিটি শিশু। গলার স্বর পরিবর্তিত হওয়া,হুট করে লম্বা হয়ে যাওয়া এসব দেখতে পাই আমরা। বিকাশের ক্ষেত্রে শিশুর আচার আচরণে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 

 

শিশুরা নরম মাটির মতো। তাদের যেভাবে ইচ্ছা গড়ে তোলা যায়। শুধু প্রয়োজন মানসিক বিকাশের জন্য সঠিক সময়ে সঠিক গাইডেন্স এবং শারীরিক বিকাশে সঠিক পুষ্টি। 

 

শিশুর বিকাশে কি সমস্যা হচ্ছে?

 

ঠিক বয়সে ঘাড় সোজা রাখতে না পারা, বসতে না পারা, হাঁটতে না পারা, কথা বলতে না পারা বা কথা অস্পষ্টভাবে বলা, অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটা, বড় বয়সেও বিছানায় প্রস্রাব-পায়খানা করা, মুখ দিয়ে সব সময় লালা পড়া, বয়স অনুযায়ী নিজের যত্ন নিজে নিতে না পারা, অস্বাভাবিক আচরণ করা, মনোযোগের অভাব, আগ্রাসী-হঠকারী আচরণ করা, হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, অতিরিক্ত চুপচাপ বা অতিরিক্ত চঞ্চল হওয়া, সমবয়সী কারও সঙ্গে মেলামেশা না করা, আদর গ্রহণ না করা, চোখে চোখ না রাখা, খিঁচুনি হওয়া, টাকাপয়সার হিসাব রাখতে অপারগতা, নিজের শরীরে নিজে ক্ষতি করা (হাত কাটা, চুল ছেঁড়া, হাত কামড়ানো, দেয়ালে মাথা ঠোকা, আত্মহত্যার চেষ্টা), স্কুলে যেতে না চাওয়া, খুব বেশি মন খারাপ করে থাকা, যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ করা ইত্যাদি লক্ষণ দেখলে বুঝতে হবে শিশুর বিকাশের সমস্যা হচ্ছে। শিশুর বিকাশের সমস্যার কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ, যত দ্রুত শিশুকে পরিচর্যায় আনা যায় ততই মঙ্গল। 

শেষের কথা

 

প্রতিটি মা-বাবাই চান তার শিশুর পূর্ণ বিকাশ হোক। আর দিনশেষে একটি শিশুর যথাযথ বিকাশের মাঝেই দেশের ভবিষ্যৎ নিহিত। তাই শিশুর বিকাশে সর্বোচ্চ নজরদারি থাকা বাঞ্ছনীয়। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *