যোগ ব্যায়ামের আদ্যোপান্ত

যোগ ব্যায়াম তথা ইয়োগার কথা কমবেশি আমরা সবাই জানি। সংজ্ঞার কথা বললে একটি নিদিষ্টি নিয়মে মনঃ সংযোগ করার মাধ্যমে স্থির ভাবে অবস্থান করাকে বা ইয়োগা বা যোগ ব্যায়াম বলে।


যোগব্যায়াম কে বিভিন্ন নামে ডাকতে শোনা যায় । একে, প্রাণায়ন, যোগা, ইয়োগা বলেও ডাকা হয়। যোগ ব্যায়ামের একটি শাখা হলো যোগাসন। যেখানে আসন বা বসার মাধ্যমে যোগ ব্যায়াম করা হয়। একটি বলা চলে একপ্রকার আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া যেখানে দেহ, মন এবং আত্মাকে একত্রিত করা হয়। (যোগা)) এই শব্দটি হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে ধ্যান প্রক্রিয়া সম্পর্কিত। যোগ শব্দটি সংস্কৃত থেকে এসেছে। যার অর্থ হল ‘যোগ করা’,”নিয়ন্ত্রণ করা”, “যুক্ত করা” বা “ঐক্যবদ্ধ করা”। “যোগ” শব্দটির আক্ষরিক অর্থ তাই “যুক্ত করা”। যোগ-ব্যায়াম হল দেহ এবং চেতনার মিলন।


যোগব্যায়াম এখন চীন, জাপান, তিব্বত, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মে ছড়িয়ে পড়েছে এবং লোকেরা এই সময়ে সমস্ত সভ্য বিশ্বে এর সাথে পরিচিত।যোগব্যায়াম ধর্ম এবং বিশ্বাসের বাইরে একটি বিজ্ঞান। এটি আমাদের জীবনের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত শারীরিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, মানসিক দিকগুলিতে কাজ করে।


মন, শরীর এবং আত্মার সর্বোৎকৃষ্ট সাফল্যের পরিপূর্ণ উপায় হিসাবে ভারতের ঋষিমুনিরা হাজার হাজার বছর আগে এই যোগ উদ্ভাবন করেছেন। তার উল্লেখও পাওয়া যায় ঋক বেদের মতো প্রাচীন পৌরাণিক বইগুলিতে।

 

বিস্তারিত ব্যখ্যা ও উপকারিতা নিয়ে বলার আগে জানিয়ে রাখি প্রতি বছর ২১ জুনকে বিশ্ব যোগ দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ।


যোগ ব্যায়াম করার উপকারিতা

  • যোগ ব্যায়াম শক্তি ও ভারসাম্য বাড়ে নমনীয়তা
    যোগ ব্যায়ামের প্রক্রিয়াটি বেশ ধিরস্থিরভাবে করতে হয়। ধীর হবার ফলে এবং গভীর শ্বাস- প্রশ্বাস রক্ত ​​​​প্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করে। সেই সাথে পেশী গুলিকে উষ্ণ করে তোলে। যখন একটি নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে যোগ ব্যায়াম করা হয় তখন শারীরিক শক্তি সঞ্চয় হয়।
  • যোগ ব্যায়ামের ফলে পিঠের ব্যাথা উপশম হয় যোগ ব্যায়াম বেশ উপকারী। আমেরিকান কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস দীর্ঘস্থায়ী পিঠের ব্যথার জন্য প্রথম লাইন এর চিকিৎসা হিসেবে এই ব্যায়াম নিয়মিত করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
  • যোগ ব্যায়ামের ফলে হৃৎপিণ্ডের উপকার হয়।
    নিয়মিত যোগ ব্যায়াম অনুশীলন এর ফলে মানসিক চাপ অনেকাংশেই কমে যেতে পারে । তার পাশাপাশি এই ব্যায়াম শরীর জুড়ে নানাবিধ ব্যাথা কমিয়ে দেয়। যা সুস্থ হৃদয় গঠনে বিশাল অবদান রাখে। উচ্চ রক্তচাপ এবং অতিরিক্ত ওজন সহ হৃদরোগ এর মতো বেশ অনেক কঠিন অসুখ এর সমধান যোগ ব্যায়াম এর মাধ্যমেও করা যেতে পারে।
  • যোগ ব্যায়াম আপনাকে শিথিল করে এবং আরও ভাল ঘুমাতে সাহায্য করে এক গবেষণায় দেখা যায় যে, একটি ভালো মানের ঘুম পেতে যোগ ব্যায়াম রুটিন আপনাকে অনেক সাহায্য করতে পারে । আপনার শরীরকে ঘুমিয়ে পড়তে এবং ঘুমিয়ে থাকার জন্য প্রস্তুত করতে এই ব্যায়াম বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
  • যোগ ব্যায়াম এর ফলে শারীরিক ক্ষমতা বাড়ায় বাড়ে ইতিবাচকতা আপনি যোগ ব্যায়াম অনুশীলন এর রুটিনে আসার পরে মানসিক এবং শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি, সতর্কতা এবং উৎসাহ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ফলে আপনি একজন ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি হবে। সহজে আপনাকে নেতিবাচক চিন্তা প্রভাবিত হবেন না।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় অসংখ্য গবেষণায় বাত, অস্টিওপেনিয়া, ভারসাম্যের সমস্যা, অনকোলজি, মহিলাদের স্বাস্থ্য, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা এবং অন্যান্য বিশেষত্বে এই ব্যায়াম এর উপকারিতা দেখা যায়।
  • যোগ ব্যায়াম আপনার মানসিক স্বাস্থ্য হবে আরো উন্নত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ এর মতে, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এ দেখায় যে যোগ ব্যায়াম স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট, মানসিক স্বাস্থ্য, মননশীলতা, স্বাস্থ্যকর খাওয়া, ওজন হ্রাস এবং মানসম্পন্ন ঘুম সমর্থন করে থাকে।


যোগ ব্যায়ামের ক্ষেত্রে সতর্কতা
যোগাসনের সময় ঢিলে ঢালা পোশাক পরা উচিত যাতে যোগাসন আরামদায়ক হয়। হালকা ঢিলেঢালা ধরনের পোষাক পরার সুবিধা হল এতে করে আপনি যোগ ব্যায়ামের যেকোনো ভঙ্গি করতে পারবেন সহজেই। বয়সসীমা নির্বিশেষে যেকোনো বয়সের নারী–পুরুষ যোগাসন করতে পারেন। তবে একা একা অনুশীলন না করে কোনো অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের সহায়তা নেওয়া ভালো। শরীরের ওপর অতিরিক্ত জোর দিয়ে অথবা শরীরে ব্যথা নিয়ে যোগাসন করা ঠিক নয়, প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না । নিয়ম মেনে গর্ভাবস্থায় যোগব্যায়াম অনুশীলন খুবই উপকারী। তবে অনুশীলনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।


যোগাসন করার সঠিক সময়
বিশেষজ্ঞদের মতে, যে সময়ে ব্যায়াম করলে নিজের মন ভাল লাগবে, সে সময়ে করলেই সবচেয়ে ভাল কাজ হয়। সকালে ব্যায়াম করলে দিনটা ভাল ভাবে শুরু হয়। তবে যোগ নিয়ে কাজ করা অভিজ্ঞজনেরা বলেন,যোগ সকাল-সন্ধ্যায় অভ্যাস করার জন্য নয়। যোগ হল বিশেষ এক ভাবে বাঁচা। নিজেকে যোগ হয়ে উঠতে হয়। যদি সেটা সকাল-বিকেলের যোগ হয়,
তবে বাকি সময়টা জটিলতায় জড়িয়ে থাকা – সেটা যোগ নয়, শুধুই যোগের অভ্যাস।

 

এবার জানিয়ে রাখি ৫টি উপকারী যোগব্যায়াম

ভুজঙ্গাসন বা কোবরা পোজ
এই পদ্ধতিতে বুকের অবস্থান এমন হবে যেন সাপের ফনার মতো দেখতে লাগে। যারা যোগব্যায়াম প্রথম করছেন তাঁদের জন্য উপকারী। শুধুমাত্র শ্বাসকষ্ট থেকেই মুক্তি দেয় তা নয়, পাশাপাশি মানসিক উদ্বেগ কমায়। সার্বিকভাবে খুশি রাখে মনকে।

 

অর্ধ মৎস্যেন্দ্রাসন বা হাফ ফিশ পোজ
শরীরে উপরের অংশের সঙ্গে নিচের অংশের অবস্থান এমন হবে যেন ঠিক মাছের মতো দেখতে লাগে। এটি স্বাভাবিকের চেয়ে গভীর শ্বাস নিতে সাহায্য় করে। ফুসফুসের পেশী আরও ভাল করে সঞ্চালন করে। এটি শরীরের রক্ত সঞ্চালন সচল রাখে। মানসিক উদ্বেগের সময় স্বস্তি দেয়।

 

শবাসন
তৃতীয় পোজ়টি অপেক্ষাকৃত কঠিন। সারা দিন, সপ্তাহ, এমনকী বছরভর আমরা আমাদের শরীরের সঙ্গে চিন্তাকে বয়ে নিয়ে বেড়াই। যা আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের ধরনের উপরও প্রভাব ফেলে। শবাসন মূলত একটি বিশ্রাম নেওয়ার পোজ়। নিজের মাথা থেকে বাইরের চিৎকার, উত্তেজনা, উদ্বেগ থেকে মুক্ত করার পদ্ধতি শবাসন।
আরও ভালভাবে শ্বাস নেওয়ার জন্য শেষ দুটি যোগাসন অবশ্যই প্রত্যেকের করা উচিত। শ্বাস প্রশ্বাসের পাশাপাশি আরও একাধিক সুবিধা পাওয়া যায় এই দুই যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে।

 

প্রাণায়াম
অনেকেই প্রাণায়ামকে গভীর প্রশ্বাস বলে ভুল করে থাকে। প্রাণায়াম অত্যন্ত ধীর একটি প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে ফুসফুসের প্রতিটি অংশে অক্সিজেন যায়। এভাবে শরীরেও শক্তি পাওয়া যায়।

 

অনুলোম-বিলোম
এটি আঙুল দিয়ে নাকের একটা অংশ চেপে ধরে অন্য অংশ নিয়ে প্রশ্বাস নিতে হয়। উল্টো পদ্ধতিও আবার অবলম্বন করতে হয়। বলা হয় এই শ্বাস প্রশ্বাসের পদ্ধতির মাধ্যমে শারীরিক এবং মানসিকভাবে উন্নতি হয়। যার মধ্যে মানসিক উদ্বেগ হ্রাস হয় এবং শ্বাস পদ্ধতি এবং রক্ত সঞ্চালনের উন্নতি হয়।

 

আমাদের ভাল থাকার জন্য যোগ ব্যায়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য, শরীর এবং মানসিকভাবে নিজেকে ভাল রাখার জন্য যোগ ব্যায়ামের বিকল্প কিছু নেই।
নিয়মিত যোগ ব্যায়াম করুন সুস্থ থাকুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *